জিজ্ঞাসা-১২৩২৭
মসজিদে প্রজেক্টর স্লাইডে খুৎবার
অনুবাদ দেখানো সম্পর্কে কী মতামত,
জানতে
চাই
بينوا توجروا? তারিখ: ০২/১১/২২ ঈসায়ি/ইংরেজি
মাওলানা ইউনুস আলী সুদান থেকে-----
জবাব: وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
نحمده ونصل على رسوله الكريم
اما بعد بسم الله الرحمن الرحيم
তাসলিম ও হামদ-সানার পর প্রথম কথা হলো, জুমুআর
খুতবা শোনা ওয়াজিব, অনুবাদ দেখা ওয়াজিব নয়। তাই খুতবা
চলাকালীন অন্য কোন কর্ম করা নিষেধাজ্ঞা এসেছে। তাই কমপক্ষে নিঃসন্দেহে মসজিদে প্রজেক্টর স্লাইডে খুৎবার অনুবাদ দেখানো
খেলাফে সুন্নাত, এতে কোন সন্দেহ নেই। নিম্নে মাসয়ালাটিকে ধারাবাহিক দালিলিক উপস্থাপন
করছি। ونسأل الله التوفيق وهو الموفق والمعين
প্রশ্ন: ক। খুতবা
শোনা ওয়াজিব তার দলিল কি?
উত্তর: ক। الفَرعُ الأوَّلُ: حُكمُ
الإنصاتِ أثناءَ الخُطبةِ
يجِبُ الإنصاتُ أثناءَ الخُطبةِ،
ويَحرُمُ الكلامُ، وهو مذهبُ الجمهور: الحَنَفيَّة، والمالِكيَّة، والحَنابِلَة،
وقولٌ للشافعي في القديمِ، وبه قال أكثرُ أهلِ العِلمِ
الأدلَّة:
أولًا: من الكِتاب
قال الله تعالى: وَإِذَا قُرِئَ
الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنْصِتُوا [الأعراف: 204]
قال الإمامُ أحمدُ: أجمَعُوا
أنَّها نزلتْ في الصَّلاةِ والخُطبةِ
(فتح الباري)) لابن رجب (5/499).
অর্থাৎ খুতবার সময় শোনার হুকুম: আর এটা সংখ্যাগরিষ্ঠদের অভিমত হানাফি
এবং মালিকিরা, এবং হাম্বলি এবং শাফির পুরাতন মত আর এটা অধিকাংশ আহলে এলেমগণ বলেছেন। দলিল:
প্রথম: কিতাব থেকে:
قال الله تعالى: وَإِذَا قُرِئَ
الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنْصِتُوا [الأعراف: 204]
অর্থ: এবং যখন কুরআন তেলাওয়াত করা হয়,
তখন তা শোন এবং আনুগত্য কর। সূরা আরাফ-২০৪
ব্যাখ্যা: ইমাম আহমাদ বলেন: তারা সর্বসম্মতিক্রমে
একমত যে এটি নামায ও খুতবায় অবতীর্ণ হয়েছে। সূত্র: ফাতহুল
বারি-৫ খণ্ড, ৩৯৯ পৃ. আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলি (রহ.)
সুন্নাত থেকে দলিল:
হাদিস/আসার নং-০১
وَجَبَ الْإِنْصَاتُ فِي
أَرْبَعَةِ مَوَاطِنَ: الْجُمُعَةِ،وَالْفِطْرِ،وَالْأَضْحَى، وَالِاسْتِسْقَاءِ.
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে
আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-চারটি স্থানে চুপ
থাকা ওয়াজিব ; জুমা, ঈদুল
ফিতর, ঈদুল আযহা এবং ইসতিসকার খুতবার সময়। মুসান্নাফে
আবদুর রাযযাক-৫৬৪২
হাদিস/আসার নং-০২
مَنْ تَوَضَّأَ
فَأَحْسَنَ الْوُضُوءَ ثُمَّ أَتَى الْجُمُعَةَ فَاسْتَمَعَ وَأَنْصَتَ غُفِرَ
لَهُ مَا بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْجُمُعَةِ وَزِيَادَةُ ثَلاثَةِ أَيَّامٍ وَمَنْ
مَسَّ الْحَصَى فَقَدْ لَغَا
অর্থ: হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল
(ﷺ) বলেছেন, যে ব্যক্তি
উত্তমরূপে অজু করল অতঃপর জুমায় এসে চুপ করে মনোযোগ সহকারে (খুতবা) শুনল, তার পরবর্তী জুমা পর্যন্ত এবং
আরো অতিরিক্ত তিন দিনের গুনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হবে। আর যে কঙ্কর স্পর্শ করল সে
অনর্থক কাজ করল। তাখরিজ: মুসলিম-৮৫৭
হাদিস/আসার নং-০৩
عن أبي هُرَيرَة رَضِيَ اللهُ عنه، أنَّ رسولَ اللهِ
صلَّى اللهُ عليه وسلَّم قال: ((إذا قُلتَ لصاحبِكَ يومَ الجُمُعةِ: أنصِتْ والإمامُ يَخطُبُ،
فقد لغوتَ. رواه البخاري (934)، ومسلم851
অর্থ: হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল
(ﷺ) বলেছেন, জুমার দিন ইমাম খুতবা দিচ্ছেন
এমন সময় যদি তোমার পাশের ব্যক্তিকে বল ‘চুপ কর’ তবে তুমি অনর্থক কাজ করলে। তাখরিজ: বুখারি-৯৩৪; মুসলিম-৮৫১
ব্যাখ্যা: হাদিসটি খুতবার সময় সব ধরণের কথাবার্তার
নিষেধাজ্ঞার ইঙ্গিত দেয় এবং এটি অন্য সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে সতর্ক করে। কারণ যদি তিনি
বলেন: শুনুন, এবং এটি মূলত একটি ভাল আদেশ, এবং তিনি এটিকে অলস কথা বলেছেন। তাই তার জন্য হারাম হওয়ার চেয়ে কথা বলা সহজ
হাদিস/আসার নং-০৪
عن ابن عمر قال : سمعت النبي صلى الله عليه و سلم يقول إذا دخل أحدكم
المسجد والإمام يخطب على المنبر فلا صلاة ولا كلام حتى يفرغ الإمام
অর্থ: আব্দুল্লাহ বিন ওমর রা. বলেন-আমি রাসূল (ﷺ) কে বলতে শুনেছি যে, যখন তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করে আর ইমাম
খুতবা দিচ্ছে মিম্বরের উপর, তাহলে ইমাম ফারিগ হওয়ার আগ
পর্যন্ত কোন নামায নেই কোন কথাও নেই। তাখরিজ: মাযমাউজ
জাওয়ায়েদ-২০১৪
ফকিহদের মতামত:
لا يجوز الكلام والإمام يخطب مع
الناس، لا مع العاطس ولا مع غيره، الواجب الإنصات لسماع الخطيب، إلا
ইমাম বায (রহ.) বলেন,
ইমাম যখন খুতবা দিচ্ছেন তখন লোকদের সাথে কথা বলা জায়েজ নয়, হাঁচিও
নয়, অন্য কারো সাথেও নয়। খতিব ছাড়া খতীবের কথা শোনা ওয়াজিব।
সূত্র: তাতবিকু
মাওসুউল ফাতাওয়াল বাযিয়্য, ইমাম ইবনে বাযের ওয়েবসাইট থেকে
আল্লামা ইবনে আব্দুল বার
বলেন: ফিকাহবিদদের মাঝে এ ব্যাপারে কোন মতভেদ নেই যে, যে ব্যক্তির কানে খোতবার শব্দ
পৌঁছে তার উপর চুপ থাকা ফরজ। সূত্র: আল-ইসতিযকার-৫/৪৩
শাইখ উছাইমিন বলেন: الإنسان إذا جاء والإمام يخطب
يوم الجمعة فإنه ويجلس، ولا يسلم على أحد، فالسلام على الناس في هذه الحال محرم؛
لأن
অর্থাৎ জুমার খোতবা চলাকালে সালাম দেয়া হারাম। অতএব, ইমামের খোতবা চলাকালে যে
ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করল তার জন্য সালাম দেয়া জায়েয নয় এবং অন্যদের সে সালামের
উত্তর দেয়াও জায়েয নয়। সূত্র:ফাতওয়ায়ে নূরি আলাল দারব-১০০; বিন
উছাইমীনের ফতোয়াসমগ্র-১৬/১০০
প্রশ্ন: খ। ইমামের খুতবা শুনার
পাশাপাশি প্রজেক্টরে অনুবাদ দেখলে সমস্যা কি?
উত্তর: খ। অনেকে যুক্তি দেয় যে, আমরা
তো ইমামের আরবি খুতবা শুনি এবং প্রজেক্টরে অনুবাদও দেখি। সুতরাং সমস্যা নেই। এর
জবাব হলো,
আল্লাহ তাআলার বাণী-
Surah Al-Ahzab, Verse 4:
مَّا جَعَلَ اللَّهُ لِرَجُلٍ
مِّن قَلْبَيْنِ فِي جَوْفِهِ
অর্থ: আল্লাহ কোন মানুষের মধ্যে দুটি
হৃদয় স্থাপন করেননি। সূরা আহজাব-০৪
প্রিয় পাঠক! মহান রব বলছেন যে মানুষের দুটি
অন্তর নেই, তাহলে এক সাথে খুতবা শুনা ও দেখা কিভাবে
সম্ভব (দুই দিকে)। সুতরাং তাদের দাবি মিথ্যা প্রমাণিত
হলো। অনুবাদ দেখতে গেলে অবশ্যই আরবি খুতবা
শুনার ব্যত্যয় ঘটবে।
আরেকটি বড় সমস্যা, তাহলো খুতবা বা কথা বলার সময় বক্তার দিকে আই কন্টাক করা আদব। অর্থাৎ খতিবের দিকে তাকানো আদব। পৃথিবীর সভ্য মানুষের নিকট একটি স্বীকৃত বিষয়।
সুতরাং ইমাম খুতবা দানকালে প্রজেক্টরের দিকে তাকালে ইমামের সাথে বেয়াদবির শামিল।
প্রশ্ন: গ। জুমুআর খুতবা কি দুরাকাত নামাজের
স্থলাভিষিক্ত, এর দলিল কি?
উত্তর: গ।
হ্যাঁ, দুরাকাতের কায়েম-মুকাম। দলিল:
হাদিস/আসার নং-০১
عن عمر بن الخطاب قال: كانت الجمعة اربعا فجعلت ركعتين
من أجل الخطبة
হযরত উমর (রা.) বলেন, জুমু’আর
নামায চার রাক’আত ছিল। এরপর খুতবার কারণে দুই রাক’আত করা হয়েছে। তাখরিজ: মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ, হাদীস-৫৩৭৪
হাদিস/আসার নং-০২
عن عمر بن الخطاب أنه قال: إنما جعلت الخطبة مكان الركعتين
হযরত উমর রা. বলেন, জুমুআর খুতবাকে দুই রাকআত নামাযের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। তাখরিজ: মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ, হাদীস-৫৩৬৭
উপরোক্ত হাদিসদ্বয়ের ইশারাতুন নস দ্বারা
প্রমাণিত হয়, যেহেতু খুতবা নামাজের স্থলাভিষিক্ত সুতরাং নামাজে যেমন কোন কর্ম করা
যায় না, তেমনি খুতবাকালীন কোনো কর্ম করা যায় না।
প্রশ্ন: ঘ। খুতবার অর্থ বুঝার জন্য আমরা অনুবাদ দেখি তাহলে অসুবিধা কি?
উত্তর: ঘ। হ্যাঁ, খুতবার অর্থ বুঝা অবশ্যই
কাম্য। তবে যেহেতু খুতবা শোনা একটি
স্বাতন্ত্র ইবাদত, শোনার জন্য নির্দেশনা এসেছে, তাই অর্থ বুঝার জন্য ইসলামি কোন
বিধান মাওকুফ নয়। যেমন নামাজের তেলাওয়াত শুনা ফরজ/ওয়াজিব; কিন্তু আমরা কয় জনও বা
সূরার অর্থ বুঝি।
আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, খুতবার আলোচ্য বিষয়
মুসলমানদেরকে বুঝানোর জন্য তো আরবি খুতবার আগে ৩০-৪০ মিনিট ওয়াজ-নছিহত করা হয়।
আর জুমুআর প্রথম আজান হওয়ার পর কোনো
ফুকাহায়া-মুফাস্সিরগণ দুনিয়ার কাজ-কর্ম নিষিদ্ধ বলেছেন। যেমন ইরশাদ হচ্ছে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ
لِلصَّلَاةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا
الْبَيْعَ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ
‘হে মুমিনগণ, জুমআর দিন যখন নামাজের জন্য আহ্বান করা হয় তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত
হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ কর। এটিই তোমাদের জন্য শ্রেয়, যদি
তোমরা উপলব্ধি কর। সূরা জুমুআ-০৯
এই আয়াতে মৌলিক ভাবে খুতবার
আজান উদ্দেশ্য হলেও মুফাসসির ও ফকীহগণের অগ্রগণ্য মত হল জুমার প্রথম আজানও এর
অন্তর্ভুক্ত হবে। সুতরাং প্রথম আজানের পর থেকেই ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ করে জুমার নামজের
প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। এ সময় অন্য কাজ করা নিষিদ্ধ। সূত্র: ফাতওয়ায়ে ইসমানি-সালাত অধ্যায়; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৩/২০৫; আদ্দুররুল মানছুর
২/২১৯; বয়ানুল কুরআন ৩/৫৪৭
সুতরাং ইসলামের নির্দেশনা হলো, আজান হয়ে গেলে
তাড়াতাড়ি মসজিদে আসা। এ হুকুম বাস্তবায়ন করলে তো অনুবাদ দেখার প্রয়োজন পড়ে না,
কারণ খতিব তো আগেই তার ব্যাখ্যা করেন। আল্লাহ তাআলা আমাদের সহিহ বুঝ দান করুন।
সারকথা হলো, জুমুআর খুতবার গুরুত্ব অনেক। আমরা
জানি আমর বিল মারুফ-নাহি আনিল মুনকার ফরজ ইবাদত; কিন্তু আমরা হাদিসে দেখতে পেলাম,
কেউ কথা বললে, তাকে চুপ থাকো বলা যাবে না। এতে প্রতিয়মান হয় যে, খুতবার গুরুত্ব কত
বড়। উক্ত হাদিসে মুখের কর্ম নিষিদ্ধ করা হয়েছে,
তাহলে চোখের কর্ম কিভাবে জায়েজ হবে।
শেষ কথা হলো, খুতবা শোনা জুরুরি, তাই খুতবা
শোনার কাজে বাধাগ্রস্থ হবে এমন কাজ-কর্ম ইসলাম নিষিদ্ধ করেছেন। আপনার প্রশ্নে উল্লেখিত মসজিদে প্রজেক্টর স্লাইডে খুৎবার অনুবাদ দেখানো
খুতবার উদ্দেশ্যের সাথে সাংঘর্ষিক এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই এটা পরিত্যাজ্য
, খেলাফে সুন্নাহ, নাজায়েজ।
والله اعلم بالصواب
উত্তর প্রদানে, মুফতি মুহাম্মাদ আব্দুর রাজ্জাক (বগুড়া)
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন